ইসলামপুর (ইংরেজি: Islampur), বাংলাদেশের সুনামগঞ্জ জেলার দক্ষিণ-পূর্ব অংশের একটি গ্রাম। এটি বৃহত্তর সিলেট বিভাগের সুনামগঞ্জ জেলার জগন্নাথপুর উপজেলার সৈয়দপুর-শাহারপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের অন্তর্ভুক্ত একটি গ্রাম।

স্থানীয়ভাবে ইসলামপুর গ্রামটি ব্রাম্মণগাঁও নামেও পরিচিত। প্রশাসনিকভাবে ইসলামপুর গ্রামটি সৈয়দপুর-শাহারপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের ৬ নং ওয়ার্ডের অন্তর্গত।

অবস্থান 

ইসলামপুর গ্রামটি জগন্নাথপুর উপজেলার সদর দপ্তরের প্রায় ছয়-সাত কিলোমিটার পূর্ব-দক্ষিণে, সিলেট শহর থেকে প্রায় ৩৫ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে এবং সিলেট-জগন্নাথপুর সড়কের আনুমানিক চার কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে ও সৈয়দপুর শাহারপাড়া ইউনিয়ন থেকে আনুমানিক এক কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত। ইসলামপুর গ্রামের উত্তর দিকে সৈয়দপুর-শাহারপাড়া ইউনিয়নের বুধরাইল, নোয়াগাও ও শাহারপাড়া  গ্রাম, দক্ষিণে আশারকান্দি ইউনিয়নের শেওরা গ্রাম ও পাইলগাঁও ইউনিয়নের আলাগদি গ্রাম, পূর্ব দিকে সৈয়দপুর-শাহারপাড়া ইউনিয়নের সুনাতনপুর ও আশারকান্দি ইউনিয়নের পাটকুরা গ্রাম, পশ্চিম দিকে রানীগঞ্জ ইউনিয়নের ঘোষগাঁও গ্রাম ও টিয়ারগাঁও এবং সৈয়দপুর-শাহারপাড়া ইউনিয়নের অনুচন্দ ও তেগরীয়া গ্রাম।

ইসলামপুর শব্দের ব্যুৎপত্তি 

ইসলামপুর দুটি শব্দের একটি যৌগিক শব্দ, ইসলাম ও পূর। ইসলাম আরাবীক মূল শব্দ "সালিমা" থেকে এসেছে; যার আক্ষরিক অর্থ শান্তি এবং পুর একটি ফারসি শব্দ। যার মানে গ্রাম, নগর বা শহর। সেই সময়ে উপমহাদেশে মুসলিম বিজেতারাদের মধ্যে ফারসি ভাষার ব্যাপক প্রচলন ছিল। পুর বাংলা ভাষায়;- বাংলা একাডেমী ব্যবহারিক বাংলা অভিধানের (২০১১) পৃ. ৭৬০এ দেখা যায়, পুর বা পুরী শব্দের আভিধানিক অর্থ পুর= (বিশেষ্যপদ) যার অর্থ আলয়, ভবন, গৃহ, নিকেতন (তোরা যাবি রাজার পুরে। -রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।) নগর, গ্রাম, শহর ইত্যাদি(হস্তিনাপুর)। {সংস্কৃত ধাতু-পু+ক্বিপ} থেকে এর আবির্ভাব। আরবি, ফারসি ও বাংলা শব্দের অর্থ অনুযায়ী "ইসলামপুর" মানে শান্তির গ্রাম।

সংক্ষিপ্ত ইতিহাস 

১৮৪৪ শতকে মানুষের প্রয়োজনের তাগিদে সবার সম্মতি ক্রমে অত্র গ্রামের পশ্চিম-পাড়ায় একটি জামে মসজিদ স্থাপন করা হয়, যার নাম দেওয়া হয় ইসলামপুর জামে মসজিদ। সে সময়ে পার্শ্ববর্তী গ্রাম সৈয়দপুর ব্যতীত অন্য কোন গ্রামে মসজিদ ছিল না। ইতিহাস থেকে জানা যায়, এই মসজিদের নামানুসারেই গ্রামের নামকরন হয়। তবে এখানে দ্বিমতও রয়েছে।

ইসলামপুর গ্রামের ইতিহাস

ঐতিহাসিক সূত্র অনুযায়ী, ইসলামপুর গ্রামটির সূচনা ১৬০০-১৭০০ শতকের গোড়ার দিকে, যখন এখানে ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ের বসবাস ছিল। সেসময় গ্রামের নাম ছিল ব্রাহ্মণগাও। তবে ১৮০০ শতকের শুরুর দিকে মুসলমানদের আগমন ঘটে এবং তারা এই গ্রামে বসতি স্থাপন করেন। সেই সময় গ্রামে কয়েকজন বিদ্বান মুনশি বসবাস করতেন, যাঁদের প্রচেষ্টায় সাধারণ মুসলমানরা ক্রমশ ধর্মীয় অনুশীলনের দিকে ধাবিত হন।

এরই ধারাবাহিকতার অংশ হিসেবে, মৌলভীবাজার মহকুমার ইটা সিংকাপন নিবাসী মাওলানা আব্দুল কাদির (ছানী) বাঙালীসহ ইটার মাওলানাগণ এই গ্রামে নিয়মিত যাতায়াত শুরু করেন। গ্রামের জনগণের ধর্মীয় অনুরাগ দেখে, তাঁদের পরামর্শক্রমে এবং গ্রামটি শতভাগ মুসলিম অধ্যুষিত হওয়ার কারণে, এই গ্রামের নাম “ইসলামপুর” হিসেবে মৌখিকভাবে স্বীকৃতি লাভ করে।

১৮৪৪ সালে, গ্রামবাসীদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় ইসলামপুর গ্রামের পশ্চিম-পাড়ায় একটি জামে মসজিদ স্থাপন করা হয়, যা “ইসলামপুর জামে মসজিদ” নামে পরিচিতি লাভ করে। বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, সে সময় পার্শ্ববর্তী সৈয়দপুর গ্রাম ব্যতীত আশপাশের কোনো গ্রামে মসজিদ ছিল না। এটি ইসলামপুরের ধর্মীয় ও ঐতিহাসিক গুরুত্বকে আরও সুসংহত করে।

এই গ্রাম বহু গর্বের ঐতিহ্য বহন করে। যখন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের পরিবর্তে সরপঞ্চ নির্বাচিত করা হত, তখন ইসলামপুর গ্রামের মরহুম সুলতান উল্লাহ (যিনি “বেপারী” নামে অধিক পরিচিত ছিলেন) সরপঞ্চ পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। এছাড়াও, ধর্মীয় শিক্ষার ক্ষেত্রে ইসলামপুর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। আশপাশের গ্রামগুলোতে যখন উল্লেখযোগ্য কোনো আলেম ছিলেন না, তখন এই গ্রামের মরহুম রোয়াইত উল্লাহ মুনশী সাহেবের জ্যেষ্ঠ পুত্র মরহুম মাওলানা আব্দুল মান্নান সাহেব ঐতিহ্যবাহী গোলাপগঞ্জের রানাপিং মাদ্রাসা থেকে কৃতিত্বের সাথে টাইটেল পাশ করেন। তিনি আমৃত্যু ধর্ম প্রচারে আত্মনিয়োগ করেন, এবং তাঁর জানাজায় বিপুলসংখ্যক মানুষের উপস্থিতি ও শিষ্যদের বক্তব্যে তাঁর অসামান্য অবদান স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

ইসলামপুর শুধু একটি গ্রাম নয়; এটি এক গৌরবময় ইতিহাসের ধারক ও বাহক, যা যুগে যুগে এ অঞ্চলের মানুষকে ধর্মীয়, সামাজিক ও ঐতিহ্যের দিক থেকে অনুপ্রাণিত করে আসছে।

ভৌগোলিক উপাত্ত 

ভৌগোলিক স্থানাঙ্ক ব্যবস্থায় এই গ্রামের অবস্থানের অক্ষাংশ ও দ্রাঘিমাংশ হল ২৪.৭৩৫৪২৫° উত্তর ৯১.৫৯৩৬৫২° পূর্ব।

জনসংখ্যার উপাত্ত 

বাংলাদেশ জাতীয় তথ্য বাতায়নের ২০১১ সালের গ্রাম ভিত্তিক লোকসংখ্যা অনুসারে ইসলামপুর গ্রামের জনসংখ্যা পূর্ব ব্রাম্মণগাও মৌজায় ৬৭১ জন এবং সোনাতনপুর মৌজায় ৩২২ জন। ইসলামপুর গ্রামের মোট জনসংখ্যা ৯৯৩ জন।

যাতায়াত ব্যবস্থা 

এ গ্রামের লোকজন শুকনো মৌসুমে সড়ক পথে পায়ে হেঁটে, রিস্কা, বাই সাইকেল, অটো রিক্সা দিয়ে এমনকি কার, লাইটএস, নোহা, হাইএস দিয়েও চলাচল করে থাকেন। বর্ষা মৌসুমে চলাফেরার জন্য এ অঞ্চলে নৌপথও ব্যবহার করা হয়। ইসলামপুরে যেতে চাইলে জগন্নাথপুর উপজেলা থেকে বাস, রিক্সা, সিএনজি অটো রিস্কা অথবা পায়ে হেটে ভবেরবাজার পয়েন্ট। ভবরবাজার থেকে রিক্সা, সিএনজি অটোরিস্কা, পায়ে হেটে সৈয়দপুর বাজার হয়ে তেগরীয়া এরপর মোরাদাবাদ থেকে অনুচন্দ এরপর ইসলামপুর। এছাড়া সৈয়দপুর বাজার থেকে বুধরাইল হয়েও যাওয়া যায়। আর সিলেট থেকে আসলে গোয়ালাবাজার থেকে বাস অথবা সিএনজি অটো রিস্কা দিয়ে নয়াবন্দর - শাহারপাড়া - নোয়াগাও - মোড়া - বুধরাইল হয়েও এই গ্রামে আসা যায়।

চিত্রশালা


ভিডিও


গুগল ম্যাপে ইসলামপুর


আরো দেখুন

ইসলামপুর গ্রামের ইতিহাস
ইসলামপুর জামে মসজিদ
সৈয়দপুর শাহারপাড়া ইউনিয়ন

তথ্যসূত্র 

গ্রামবাসী, বাংলাদেশ জাতীয় তথ্য বাতায়ন, গুগল, জিয়িওহ্যাক, ইত্যাদি।
নবীনতর পূর্বতন